আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর খুটিনাটি
যেখানে কোনো সীমান্ত নেই, সেখানে কোনো দেশ নেই, এই সীমান্ত রক্ষা আর সীমান্ত বাড়ানোর জন্য ছোট-বড় সব দেশেই রয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনী। বিভিন্ন জরিপ, পরিসংখ্যান এবং গবেষণায় আমেরিকান প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়, এ বাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তথ্য সহ নিচে দেয়ো হলো ।
তাহলে আসুন জেনে নিই আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে
শুরুর কথা
ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, ইতিহাসবিদ, সমালোচক ও লেখক বার্টান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল সংক্ষেপে বার্টান্ড রাসেল বলেছেন, যুদ্ধ কখনো কে সঠিকÑ তা বিচার করে না। শুধু কে অবিশিষ্ট আছে তা বিচার করে। ষোড়শ শতকে ইংরেজ কবি, লেখক ও নাট্যকার জন লিলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইউফুয়েস : দ্য অ্যানাটমি অব উইট’ এ বলেছেন ‘প্রেম এবং যুদ্ধে সবই সঠিক’ কারণ যাই থাকুক না কেন, এ কথা সত্য যে, পৃথিবীর মোট সম্পদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে ব্যয় এবং বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তিমত্তার একটি সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে। ২০০৬ সাল থেকে ১৩৭টি দেশের ওপর গবেষণাকারী সংস্থাটির মতে, এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে আমেরিকায়। জল, স্থল ও আকাশপথে যুদ্ধ করার সক্ষমতা, সামরিক ব্যয়, সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের সংখ্যা ইত্যাদিসহ ৫৫টি বিষয় বিবেচনা করে এই মত দিয়েছে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার। এই বিশাল বাহিনীর পেছনে আগামী বছর ৭১৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরিকল্পনা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; যা গত বছরের চেয়ে ৩৩ বিলিয়ন বা পাঁচ শতাংশ বেশি (সূত্র : সিএনবিসি নিউজ)। তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের এক বছরের বাজেট প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো এমন ১২টি দেশ চালাতে যে টাকা লাগে, প্রায় সে পরিমাণ টাকা খরচ হয় আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে।
স্টক হোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামের সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থার ২৯ এপ্রিল ২০১৯-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ২০১৮ সালে পৃথিবীর সামরিক ব্যয় এক দশমিক আট ট্রিলিয়ন (১৮০০ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করেছে। যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে দুই দশমিক ছয় শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো ৩০টি দেশ চলতে পারে বিশ্বের প্রতিরক্ষা খাতের খরচ দিয়ে। প্রতিরক্ষা খাতে খরচের দিকে থেকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশ হলো- আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব, ভারত ও ফ্রান্স। পৃথিবীর মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) খরচ করে এই পাঁচ দেশ। বাকি পৃথিবীর খরচ ৪০ ভাগ, এর মধ্যে আবার সুইডেনের এই গবেষণা সংস্থার গবেষক ড. নান টিয়ানের দাবি শুধু আমেরিকা ও চায়না মিলে পৃথিবীর মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) খরচ করে। সে হিসাবে বাকি ১০ ভাগ ও সৌদি আরব, ভারত ও ফ্রান্স এবং অবশিষ্ট ৪০ ভাগ খরচ করে গবেষণাকৃত প্রায় ১৮০টি দেশ, (সূত্র : এসআইপিআরআই)।
আমেরিকার মতো একটি দেশ কেন এই বিশাল অঙ্কের টাকা প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে। তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমনÑ লেখক, সাংবাদিক গবেষক ও শান্তিকামীদের কানাডাভিত্তিক সংগঠন গ্লোবাল রিসার্চ বলছে, ১৭৭৬ সালে আমেরিকা প্রতিষ্ঠার পর ২৪৪ বছরের ইতিহাসে মাত্র ২১ বছর শান্তিতে ছিল। অবশিষ্ট ২৩৯ বছরই আমেরিকান সৈন্যরা কোথাও না কোথাও যুদ্ধ করেছে। দিন-ক্ষণের হিসাবে ইতিহাসের ৯৩ শতাংশ দিন বা গড়ে বছরের ৩৪০ দিন যুদ্ধ করেছে আমেরিকান সৈন্যরা আর ২৫ দিন শান্তিতে ছিল। এই উপাত্তকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন স্মিথ সোনিয়ান ম্যাগাজিনের জানুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় ‘এ ন্যাশন অ্যাট আর্মস’ প্রবন্ধে গবেষক ডেভিড লভেট দেখিয়েছেন ১৭৭৫ থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের ৯৩.৫ শতাংশজুড়ে অর্থাৎ গড়ে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৪১ দিনেরও বেশি যুদ্ধ করেছে আমেরিকানরা।
ম্যাগাজিনের একই সংখ্যায় ‘আমেরিকা অ্যাট ওয়ার’ শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক স্টিফেনি সাভেল তথ্যচিত্রসহ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, বিশ্বে এই মুক্ত মুহূর্তে ৮০টি দেশে সামরিক কারণে অবস্থান করছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এজন্য তারা অবস্থান করছে ৪০টি ইউএস মিলিটারি বেইস বা সামরিক স্থাপনায়। তার মতে, ৬৫টি দেশে জঙ্গিবিরোধী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আমেরিকান সেনারা আর ২৬টি আলাদা আলাদা সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে বিশ্বজুড়ে।
রীতি মেনে রিজার্ভ
আমেরিকার সংবিধানের অষ্টম অধ্যায়ের প্রথম ধারা ইউএস কোড ২৪৬ এবং ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রবর্তিত ৪৭৭১ নং বিশেষ ধারা অনুসারে আমেরিকার পুরুষ নাগরিকের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করার জন্য নথিভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। আইনানুসারে আমেরিকার একজন যুবককে ১৮তম জন্মদিনের ২৩০ দিনের মধ্যে ‘সিলেকটিভ সানির্ভস সিস্টেম (সংক্ষেপে এসএসএস) নামক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংরক্ষিত সেনা বা রিজার্ভ হিসেবে নাম নিবন্ধন করতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে তা ঐচ্ছিক। এই নিবন্ধন না করলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সরকারি অনুদান এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয় না। নিবন্ধনকৃতদের একটি সংক্ষিপ্ত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় প্রতি বছর ৩৯ দিনের বার্ষিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়।
এই সংরক্ষিত সৈন্যদের যে কোনো জাতীয় প্রয়োজনে যেমন দুর্যোগ মোকাবিলা এবং যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সংরক্ষিত সৈন্যদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া ১৯৯০-৯১ এ কুয়েত পুনরুদ্ধারে ৩৫ হাজারেরও বেশি সংরক্ষিত সৈন্য অংশগ্রহণ করে। সম্মিলিতভাবে এই সংরক্ষিত সেনাদের সেনা, নৌ, বিমান ও মেরিন বাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে রাশিয়ায় এই সংরক্ষিত সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ, ভারতে প্রায় ২১ লাখ এবং তিন নম্বর অবস্থানে থাকা আমেরিকায় প্রায় ৯ লাখ। তবে পুরনোসহ এই সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, প্রতি বছর ২০ লাখ আমেরিকান যুবক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছে, যাদের ৯২% বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষিত সেনা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অবশিষ্ট ৮% অসুস্থতার কারণে বাদ পড়ে অথবা আইন ভঙ্গ করায় শাস্তি ভোগ করে। যুবক-যুবতী মিলিয়ে প্রায় ৪১ লাখ আমেরিকান প্রতি বছর সামরিক চাকরিতে যোগ দেওয়ার বয়সে পৌঁছে।
সর্বেসর্বা সেনাবাহিনী
সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুদ্ধ হচ্ছে নতুন ভূমি দখল, দখল ভূমি পুনরুদ্ধার আর নিজের ভূমির দখল ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখার জন্য, আর এই কাজে স্থলবাহিনীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার জন্মলগ্ন ১৭৭৬ সাল থেকেই দেশের জন্য লড়ছে স্থলবাহিনী, যা ইউএস আর্মি নামে আজ সুপরিচিত। সে হিসেবে বলা যায়, ইউএস আর্মি ২৪৪ বছর পুরনো। বিশ্ব নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত থিংক ট্যাংক (সংগঠন) এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন (ওয়াশিংটন) ২০১৭ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে জানায় যে, আমেরিকার স্থলবাহিনীতে ৪ লাখ ৭৬ হাজার নিয়মিত স্থল সৈন্য, ৩ লাখ ৪৩ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য (মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি), প্রায় ২ লাখ রিজার্ভ সৈন্য, লক্ষাধিক অস্ত্রবিহীন সৈন্য এবং ৩ লাখ ৩০ হাজার বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।
বর্তমানে মার্কিন স্থলবাহিনীর প্রধান ফোর স্টার জেনারেল মার্ক আলেক্সাডার মিলে। আমেরিকার নিজস্ব নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশটির সার্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে এমন যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করছে এই সেনারা। ছোট-বড় ৩০টি শাখার সমন্বয়ে মার্কিন স্থলবাহিনী গড়ে উঠেছে। যেমন পদাতিক বাহিনী, সাঁজোয়া বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিগন্যাল ও মেডিকেল কোর ইত্যাদি। উত্তর ক্যারোলিনা, টেক্সাস, আলাবামা ও ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত চারটি পৃথক কমান্ড সদরের অধীনে ২৪টি শাখার মাধ্যমে এই বাহিনী পরিচালিত হয়।
ক্ষুদ্র পিস্তল থেকে শুরু করে বিমান বিধ্বংসী কামান, শক্তিশালী মিসাইল, বিভিন্ন আকারের ট্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে সুসজ্জিত ও সুদক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কিন সেনাদের। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক কাজের জন্য মার্কিন স্থলবাহিনীর উড্ডয়ন শাখায় নানা আকৃতির ১৯৩টি বিমান, ৩৩৭২টি হেলিকপ্টার, ৬১৭৫টি চালক বা পাইলট ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম ছোট বিমান বা ড্রোন রয়েছে। তবে ডোনের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে।
এ ছাড়া পানিপথে চলাচল ও যুদ্ধের জন্য ৫০টি নানা আকৃতির জলযানও রয়েছে মার্কিন স্থলবাহিনীর (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। তবে অন্য কিছু উৎসে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে তথ্য পাওয়া যায়। গ্লোবাল ফায়ার এই তথ্যের বাইরে আরও তথ্য দিয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে। এই তথ্য মোতাবেক সামরিক শক্তিতে বলিয়ান শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো যথাক্রমে : আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত ও ফ্রান্স।
আকাশ ছোঁয়া সাফল্যে বিমান বাহিনী
মাটির নিচের বাংকার, কোনো দুর্ভেদ্য দুর্গ, সাগরের জাহাজ কিংবা আকাশে উড্ডীয়মান কোনো বিমান-শত্রুর অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, তা সমূলে ধ্বংস করার সক্ষমতা রয়েছে আমেরিকা বিমান বাহিনীর। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মোতাবেক বর্তমানে মার্কিন বিমান বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত জঙ্গি বিমানগুলোর মধ্যে ফাইটার বিমান ২,৩৬২টি, অ্যাটাক বিমান ২৮৩১টি, পরিবহন বিমান ১১৫৩টি, প্রশিক্ষণ বিমান ২৮৫৩টি। এ ছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই বিমানবাহিনী পরিচালনা করছে ৫৭৬০টি হেলিকপ্টার, যার মধ্যে ৯৭১টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার। বিমান বহরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় টি সিক্স-এ ট্যাক্সান টু এবং টি ৩৮৩ ট্যালন নামক প্রশিক্ষণ বিমান। আকাশে উড়ন্ত জঙ্গি বিমানে তেল সরবরাহের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় কেসি ১৩৫ স্ট্যাটোট্যাংকার বিমান রয়েছে ৩৪২টি।
পরিবহন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয় সি-১৭এ গ্লোব মাস্টার থ্রি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার এয়ারক্রাফট হিসেবে মার্কিন বিমান বাহিনীর আস্থা ধরে রেখেছে বহুল পরিচিত ও আলোচিত এফ-১৬ সি ফাইটিং ফ্যালকন। এমনি ধরনের বিভিন্ন কোম্পানি ৮৯ মডেলের বিমানে সুসজ্জিত মার্কিন বিমান বাহিনী। অন্যদিকে ৪১ ধরনের হেলিকপ্টার নিয়ে গড়ে উঠেছে মার্কিন বিমানবাহিনী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নানাবিধ কাজের উপযোগী বেল ২০৬ হেলিকপ্টার, এরপরই রয়েছে সিকরস্কা ইউএইচ ৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার। তল্লাশি ও তদন্ত কাজে পারদর্শী বেল ওএইচ-৫৮ কিওয়া এবং বেল এইচ-১৩ সিওয়াক্স হেলিকপ্টার। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণে পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম ভেরটল এইচ ২১ কার্গো হেলিকপ্টার।
অন্যদিকে সমুদ্রের পানির নিচে থাকা সাবমেরিনের অবস্থান বের করে তা ধ্বংস করতে পারে কামান এসএইচ-২ সিস প্রাইট হেলিকপ্টার। আমেরিকার বিখ্যাত বোয়িং কোম্পানির সিএইচ-৪৭ সিনুকে হেলিকপ্টারও রয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনীতে। ছয়টি ব্লেডের দুই সেট পাখাবিশিষ্ট এই হেলিকপ্টার ছোটখাটো বিমান, জাহাজ, ট্যাঙ্ক, কামান, গাড়ি এবং সরঞ্জামসহ ৮১ জন সৈন্য বহন বা দড়িতে দড়িতে ঝুলিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে সক্ষম। বর্তমানে মার্কিন বিমান বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছেন ফোর স্টার জেনারেল ডেভিড লি গোল্ড ফিয়েন। দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে অবস্থান করছে মার্কিন বিমান সেনারা।
না বলতে জানে না মার্কিন নৌ সেনা
বিভিন্ন দিক বিবেচনায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৌবাহিনী হিসেবে স্বীকৃত আমেরিকার নৌবাহিনী। সবচেয়ে বেশি বাজেট, শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ আর ব্যাপক জনবলের কারণে পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আমেরিকার নৌবাহিনী। শুধু আকার বা শক্তিমত্তাই নয়, গতিশীলতা এবং জল, স্থল এমনকি আকাশপথেও দ্রুত চলাচলের সামর্থ্য আমেরিকান নৌবাহিনীকে একটি আদর্শ ত্রিমাতৃক বাহিনীর মর্যাদা দিয়েছে। আমেরিকার নৌবাহিনীর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ৩,৩৪,০৬৯ জন নিয়মিত নৌ সেনা, লক্ষাধিক রিজার্ভ নৌ সেনা ২,৭৪,৮৫৪ জন বেসামরিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আমেরিকার নৌবাহিনী। এই বিশাল জনশক্তির অধীনে চলছে যুদ্ধে মোতায়েনের মতো ছোট বড় ২৯০টি নৌযান।
এর মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে আছে ১১২টি সাবমেরিন, যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ৬৫টি যুদ্ধ জাহাজ আর নিজস্ব জলসীমা পাহারা দিচ্ছে ৪৭টি যুদ্ধ জাহাজ। বিভিন্ন মহাসাগরে ভাসানো হয়েছে ছয়টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যেখানে অনায়াসে ওঠানামা করতে পারে বিভিন্ন জঙ্গিবিমান। নৌবাহিনী বলতে সাধারণভাবে সমুদ্রে বা জলে বিচরণকারী জাহাজ ও নৌ যোদ্ধাদের চিহ্নিত করা হলেও আধুনিক নৌবাহিনী যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ত্রিমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। তাই আমেরিকার নৌবাহিনীর জাহাজ পানিতে ভাসে, নৌ বাহিনীরই নিজস্ব বিমান আকাশে ওড়ে এবং উভচর যান একই সঙ্গে জল ও স্থলে চলাচল করে শত্রুকে ঘায়েল করে। অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ছয় ধরনের যুদ্ধ জাহাজের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
যার প্রথমেই রয়েছে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং এম্ফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ, যা জল ও স্থলে চলতে পারে। এর পরই দেখানো হয়েছে ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ। যা একসঙ্গে একাধিক লক্ষবস্তুতে আঘাত করতে পারে। অন্য কোনো বন্ধুপ্রতিম বাহিনীকে সাহায্য করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে নির্দিষ্ট অভিযান চালাতে পারে। লিটোরাল কম্বেট শিপ রয়েছে পরের কাতারে। যা মূলত ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ মূলত উপকূলীয় এলাকায় যুদ্ধ করে, তবে প্রয়োজনে মাঝ সমুদ্রেও যেতে পারে। এই কম্বেট শিপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে ডেস্ট্রয়ার প্রকৃতির যুদ্ধজাহাজ। গতি ও ক্ষিপ্রতায় এ দুই ধরনের জাহাজ প্রায় এক রকম হলেও ডেস্ট্রয়ার নিজস্ব জলসীমা ও ভূখন্ডে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়। গভীর সমুদ্রে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন, যা যুদ্ধের সময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এসব সাবরেমিন, পারমাণবিক অস্ত্র বহন ও নিক্ষেপের কাজেও ব্যবহৃত হয়। ২০১৫ সালে শক্তিশালী আমেরিকান নৌবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন অ্যাডমিরাল জন রিচার্ডসন। নৌবাহিনীর মূল যুদ্ধজাহাজ হিসেবে আদিকাল থেকে ‘ফ্রিগেট’ ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকান নেভিতে বর্তমানে ২২টি ফ্রিগেট আছে। যার মূল কাজ শত্রুর হাত থেকে নিজ জলসীমার সব যুদ্ধযান, অন্যান্য রণতরী, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইত্যাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব ফ্রিগেটে বিমান হামলা বা সাবমেরিন হামলা প্রতিহত করার সক্ষমতা আছে।
আবার ফ্রিগেটের নিজস্ব কামান স্থলভাগের দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বা শত্রুর বিমান ধ্বংস করতে পারে। যে কোনো রণতরীকে চারপাশের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ২৭টি করভেটিস (ছোট রণতরী) রয়েছে আমেরিকার হাতে আরও রয়েছে দ্রুতগতির ক্রুজার। বিশ্বে নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ করে আমেরিকা। ২০২০ সালে আমেরিকা তার নৌবাহিনীর জন্য প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দ চেয়েছে। আমেরিকার নেভির সার্বিক শক্তিমত্তার একটি পরিচয় পাওয়া যায় উইকিপিডিয়ায় লিস্ট অব কান্ট্রিস বাই লেভেল অফ মিলিটারি ইকুইপমেন্ট বিভাগে।
মৃত্যুজয়ী এলিট ফোর্স মেরিন কোর
মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে এলিট ফোর্স হিসেবে স্বীকৃত মেরিন কোর, সংক্ষেপে ইউএস মেরিন। কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে গত মাসে (জুন ২০১৯) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন জেনারেল ডেভিড ইলবেরি বার্গারের হাতে। জল, স্থল ও আকাশপথে সমানতালে যুদ্ধ করার জন্য এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে সুদক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। স্বতন্ত্র অভিযান, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানে সমানভাবে পারদর্শী মেরিন সেনারা। যুদ্ধকৌশল হিসেবে যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযানে নামানো হয় মেরিন সেনাদের। নিজ দেশে অবস্থান থেকে অনেক দূরে এমনকি শত্রু এলাকার অভ্যন্তরে কিংবা আরেকটি দেশে যুদ্ধ করতে কোনো দ্বিধা করে না মেরিন ফোর্স। আবার জল-স্থলে সমানভাবে যুদ্ধ করতে পারে বলে তারা উভচর বাহিনী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। উইকিপিডিয়ার হিসাবে ২০১৭ সালে মেরিন কোরে ১,৮২,০০০ নিয়মিত সৈন্য, ৩৮,৫০০ সংরক্ষিত সৈন্য এবং ১,৩০৪টি যুদ্ধবিমান ছিল। যে কোনো যুদ্ধে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরিন সৈন্যরা।
তারপর ক্রমান্বয়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে সার্বিক যুদ্ধে একটা সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা রয়েছে এই দলের। অস্ত্র হিসেবে প্রতিটি মেরিন সেনা কমপক্ষে একটি এম ১৬ রাইফেল অথবা এম ফোর কারবাইন অথবা কল্ট ৯ মি: মি: এসএমজি বহন করে। এ ছাড়াও ভারী মেশিনগান, গ্রেনেড নিক্ষেপের লাঞ্চার, কামান ও ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট এবং ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল চালনায় পারদর্শী মেরিন সৈনারা।
রণকৌশল হিসেবে মেরিন সেনারা সাধারণত নৌযানে করে উপকূলে পৌঁছে। ২০১৯ সালে মেরিন কোরের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ৪৩,১৫২ মিলিয়ন ডলার, যা পৃথিবীর বহু দেশের মোট বাজেটের চেয়েও বেশি। এই বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় জল, স্থল, ও আকাশপথে চলাচলের জন্য সাধারণ যানবাহন, জঙ্গিবিমান, যুদ্ধজাহাজ, মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট, ট্যাংক, কামান ও অন্যান্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
পরমাণুতে পরাক্রমশালী
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মূল দায়িত্ব পালন করছে জাতিসংঘ। অথচ জাতিসংঘের মোড়ল বলে স্বীকৃত ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং আমেরিকার হাতে রয়েছে চরম বিধ্বংসী মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা। এই পাঁচটি দেশই আবার আন্তঃমহাদেশীয় বেলাস্টিক মিসাইল ব্যবহার করে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে পারমাণবিক বোমা ফেলে দেশটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র গোপনে তৈরি করেছে অথবা তৈরির প্রক্রিয়ার আছে বলে মিডিয়ায় শিরোনাম হয় পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশ। তবে বিশ্বের বুকে সবার দুশ্চিন্তার কারণ আমেরিকা।
কারণ আমেরিকাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আমেরিকার একটি বোমারু বিমান জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ নামের ৪,৪০০ কেজি ওজনের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে ৬৬ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৬৯ হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয়, যাদের অধিকাংশ পরে মারা যায়। ঠিক তিন দিন পর ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট আমেরিকার আরেকটি যুদ্ধবিমান আবারও জাপানের নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাটম্যান’ নামের ৪,৬৭০ কেজি ওজনের আরেকটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এ ক্ষেত্রে ধ্বংস হয় নাগাসাকি শহর এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু
র কোলে ঢোলে পড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। একই সংখ্যক মানুষ অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয়ে পরবর্তীতে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করে এবং ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আমেরিকা এভাবে যুদ্ধে ব্যবহার ছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে ১০৫৪টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার হাতে সর্বোচ্চ ৩,১২,৫৫৫টি পারমাণবিক বোমা বা পারমাণবিক অস্ত্র ছিল।
পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্দোলন ও শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা কমতে থাকে। ১৯৯০ এর কাছাকাছি সময়ে সংখ্যা কমে প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছে। বর্তমানে ইউকিপিডিয়ার মতে, আমেরিকার হাতে প্রায় ৪,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র (বোমা) আছে, যার মধ্যে প্রায় ১,৮০০টি মোতায়েনকৃত এবং যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই ক্ষমতাবলেই আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ এবং মিলিটারি সুপার পাওয়ার বলে বিবেচিত।
ছোট-বড় বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের সক্ষমতা রয়েছে আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির নাম ডেভিক্রকেট, যা বাংলাদেশের একটি সাধারণ ঢেঁকির সমান।
আমেরিকা নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার এবং ক্রুজারজাতীয় যুদ্ধজাহাজ এবং তিন ধরনের সাবমেরিন ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে জল-স্থল বা আকাশে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। আমেরিকার গোলন্দাজ বাহিনীও বিশেষ কামানের মাধ্যমে পরমাণু বোমা সংযুক্ত শেল নিক্ষেপ করতে পারে।
আর বিমান বাহিনী এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা প্রমাণ করেছে নানা প্রকার সামরিক মহড়া ও পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের সময়। আমেরিকার যে কোনো বড় আকারের পারমাণবিক বিস্ফোরণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রেসিডেন্টের যিনি সার্বিকভাবে সেনা, নৌ, বিমান ও মেরিন বাহিনীরও সর্বময় প্রধান বা কমান্ডার ইন চিফ। এই আদেশটি একটি বিশেষ কোড আকারে দিয়ে থাকেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতার ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এক নজরে ২০১৭ সালের মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনী
👉 নিয়মিত সৈন্য (স্থলবাহিনী) ৪,৭২,০৪৭ জন
👉 আর্মি ন্যাশনাল গার্ড ৩,৪৫,১৫৩ জন
👉 নিয়মিত নৌ সেনা ৩,১৯,৪৯২ জন
👉 নিয়মিত বিমান সেনা ৩,১৮,৫৮০ জন
👉 আর্মি রিজার্ভ (সংরক্ষিত সেনা) ২,১৯,০৫৪ জন
👉 নিয়মিত মেরিন সৈন্য ১,৮৪,৪০১
👉 এয়ার ন্যাশনাল গার্ড ১,০৫,৬৭০ জন
👉 মেরিন কোর রিজার্ভ (সংরক্ষিত মেরিন সেনা) ১,০৪,৪১৯ জন
👉 সংরক্ষিত নৌ সেনা ১,০৩,৬৬০ জন
👉 সংরক্ষিত বিমান সেনা ৯৯,২৬৯ জন
👉 নিয়মিত কোস্টগার্ড সৈন্য ৪০,৬০০ জন
👉 সংরক্ষিত কোস্টগার্ড সৈন্য ৭,৮৫৭ জন
সূত্র : মার্কেট পোর্টাল স্টেটিসটিকা.কম
তাহলে আসুন জেনে নিই আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে
শুরুর কথা
ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, ইতিহাসবিদ, সমালোচক ও লেখক বার্টান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল সংক্ষেপে বার্টান্ড রাসেল বলেছেন, যুদ্ধ কখনো কে সঠিকÑ তা বিচার করে না। শুধু কে অবিশিষ্ট আছে তা বিচার করে। ষোড়শ শতকে ইংরেজ কবি, লেখক ও নাট্যকার জন লিলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইউফুয়েস : দ্য অ্যানাটমি অব উইট’ এ বলেছেন ‘প্রেম এবং যুদ্ধে সবই সঠিক’ কারণ যাই থাকুক না কেন, এ কথা সত্য যে, পৃথিবীর মোট সম্পদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে ব্যয় এবং বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তিমত্তার একটি সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে। ২০০৬ সাল থেকে ১৩৭টি দেশের ওপর গবেষণাকারী সংস্থাটির মতে, এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে আমেরিকায়। জল, স্থল ও আকাশপথে যুদ্ধ করার সক্ষমতা, সামরিক ব্যয়, সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের সংখ্যা ইত্যাদিসহ ৫৫টি বিষয় বিবেচনা করে এই মত দিয়েছে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার। এই বিশাল বাহিনীর পেছনে আগামী বছর ৭১৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরিকল্পনা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; যা গত বছরের চেয়ে ৩৩ বিলিয়ন বা পাঁচ শতাংশ বেশি (সূত্র : সিএনবিসি নিউজ)। তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের এক বছরের বাজেট প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো এমন ১২টি দেশ চালাতে যে টাকা লাগে, প্রায় সে পরিমাণ টাকা খরচ হয় আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে।
স্টক হোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামের সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থার ২৯ এপ্রিল ২০১৯-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ২০১৮ সালে পৃথিবীর সামরিক ব্যয় এক দশমিক আট ট্রিলিয়ন (১৮০০ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করেছে। যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে দুই দশমিক ছয় শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো ৩০টি দেশ চলতে পারে বিশ্বের প্রতিরক্ষা খাতের খরচ দিয়ে। প্রতিরক্ষা খাতে খরচের দিকে থেকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশ হলো- আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব, ভারত ও ফ্রান্স। পৃথিবীর মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) খরচ করে এই পাঁচ দেশ। বাকি পৃথিবীর খরচ ৪০ ভাগ, এর মধ্যে আবার সুইডেনের এই গবেষণা সংস্থার গবেষক ড. নান টিয়ানের দাবি শুধু আমেরিকা ও চায়না মিলে পৃথিবীর মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) খরচ করে। সে হিসাবে বাকি ১০ ভাগ ও সৌদি আরব, ভারত ও ফ্রান্স এবং অবশিষ্ট ৪০ ভাগ খরচ করে গবেষণাকৃত প্রায় ১৮০টি দেশ, (সূত্র : এসআইপিআরআই)।
আমেরিকার মতো একটি দেশ কেন এই বিশাল অঙ্কের টাকা প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে। তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমনÑ লেখক, সাংবাদিক গবেষক ও শান্তিকামীদের কানাডাভিত্তিক সংগঠন গ্লোবাল রিসার্চ বলছে, ১৭৭৬ সালে আমেরিকা প্রতিষ্ঠার পর ২৪৪ বছরের ইতিহাসে মাত্র ২১ বছর শান্তিতে ছিল। অবশিষ্ট ২৩৯ বছরই আমেরিকান সৈন্যরা কোথাও না কোথাও যুদ্ধ করেছে। দিন-ক্ষণের হিসাবে ইতিহাসের ৯৩ শতাংশ দিন বা গড়ে বছরের ৩৪০ দিন যুদ্ধ করেছে আমেরিকান সৈন্যরা আর ২৫ দিন শান্তিতে ছিল। এই উপাত্তকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন স্মিথ সোনিয়ান ম্যাগাজিনের জানুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় ‘এ ন্যাশন অ্যাট আর্মস’ প্রবন্ধে গবেষক ডেভিড লভেট দেখিয়েছেন ১৭৭৫ থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের ৯৩.৫ শতাংশজুড়ে অর্থাৎ গড়ে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৪১ দিনেরও বেশি যুদ্ধ করেছে আমেরিকানরা।
ম্যাগাজিনের একই সংখ্যায় ‘আমেরিকা অ্যাট ওয়ার’ শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক স্টিফেনি সাভেল তথ্যচিত্রসহ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, বিশ্বে এই মুক্ত মুহূর্তে ৮০টি দেশে সামরিক কারণে অবস্থান করছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। এজন্য তারা অবস্থান করছে ৪০টি ইউএস মিলিটারি বেইস বা সামরিক স্থাপনায়। তার মতে, ৬৫টি দেশে জঙ্গিবিরোধী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আমেরিকান সেনারা আর ২৬টি আলাদা আলাদা সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে বিশ্বজুড়ে।
রীতি মেনে রিজার্ভ
আমেরিকার সংবিধানের অষ্টম অধ্যায়ের প্রথম ধারা ইউএস কোড ২৪৬ এবং ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রবর্তিত ৪৭৭১ নং বিশেষ ধারা অনুসারে আমেরিকার পুরুষ নাগরিকের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করার জন্য নথিভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। আইনানুসারে আমেরিকার একজন যুবককে ১৮তম জন্মদিনের ২৩০ দিনের মধ্যে ‘সিলেকটিভ সানির্ভস সিস্টেম (সংক্ষেপে এসএসএস) নামক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংরক্ষিত সেনা বা রিজার্ভ হিসেবে নাম নিবন্ধন করতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে তা ঐচ্ছিক। এই নিবন্ধন না করলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সরকারি অনুদান এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয় না। নিবন্ধনকৃতদের একটি সংক্ষিপ্ত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় প্রতি বছর ৩৯ দিনের বার্ষিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়।
এই সংরক্ষিত সৈন্যদের যে কোনো জাতীয় প্রয়োজনে যেমন দুর্যোগ মোকাবিলা এবং যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সংরক্ষিত সৈন্যদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া ১৯৯০-৯১ এ কুয়েত পুনরুদ্ধারে ৩৫ হাজারেরও বেশি সংরক্ষিত সৈন্য অংশগ্রহণ করে। সম্মিলিতভাবে এই সংরক্ষিত সেনাদের সেনা, নৌ, বিমান ও মেরিন বাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে রাশিয়ায় এই সংরক্ষিত সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ, ভারতে প্রায় ২১ লাখ এবং তিন নম্বর অবস্থানে থাকা আমেরিকায় প্রায় ৯ লাখ। তবে পুরনোসহ এই সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, প্রতি বছর ২০ লাখ আমেরিকান যুবক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছে, যাদের ৯২% বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষিত সেনা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অবশিষ্ট ৮% অসুস্থতার কারণে বাদ পড়ে অথবা আইন ভঙ্গ করায় শাস্তি ভোগ করে। যুবক-যুবতী মিলিয়ে প্রায় ৪১ লাখ আমেরিকান প্রতি বছর সামরিক চাকরিতে যোগ দেওয়ার বয়সে পৌঁছে।
সর্বেসর্বা সেনাবাহিনী
সৃষ্টির আদিকাল থেকে যুদ্ধ হচ্ছে নতুন ভূমি দখল, দখল ভূমি পুনরুদ্ধার আর নিজের ভূমির দখল ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখার জন্য, আর এই কাজে স্থলবাহিনীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার জন্মলগ্ন ১৭৭৬ সাল থেকেই দেশের জন্য লড়ছে স্থলবাহিনী, যা ইউএস আর্মি নামে আজ সুপরিচিত। সে হিসেবে বলা যায়, ইউএস আর্মি ২৪৪ বছর পুরনো। বিশ্ব নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত থিংক ট্যাংক (সংগঠন) এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন (ওয়াশিংটন) ২০১৭ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে জানায় যে, আমেরিকার স্থলবাহিনীতে ৪ লাখ ৭৬ হাজার নিয়মিত স্থল সৈন্য, ৩ লাখ ৪৩ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য (মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি), প্রায় ২ লাখ রিজার্ভ সৈন্য, লক্ষাধিক অস্ত্রবিহীন সৈন্য এবং ৩ লাখ ৩০ হাজার বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।
বর্তমানে মার্কিন স্থলবাহিনীর প্রধান ফোর স্টার জেনারেল মার্ক আলেক্সাডার মিলে। আমেরিকার নিজস্ব নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশটির সার্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে এমন যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করছে এই সেনারা। ছোট-বড় ৩০টি শাখার সমন্বয়ে মার্কিন স্থলবাহিনী গড়ে উঠেছে। যেমন পদাতিক বাহিনী, সাঁজোয়া বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিগন্যাল ও মেডিকেল কোর ইত্যাদি। উত্তর ক্যারোলিনা, টেক্সাস, আলাবামা ও ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত চারটি পৃথক কমান্ড সদরের অধীনে ২৪টি শাখার মাধ্যমে এই বাহিনী পরিচালিত হয়।
ক্ষুদ্র পিস্তল থেকে শুরু করে বিমান বিধ্বংসী কামান, শক্তিশালী মিসাইল, বিভিন্ন আকারের ট্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে সুসজ্জিত ও সুদক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কিন সেনাদের। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক কাজের জন্য মার্কিন স্থলবাহিনীর উড্ডয়ন শাখায় নানা আকৃতির ১৯৩টি বিমান, ৩৩৭২টি হেলিকপ্টার, ৬১৭৫টি চালক বা পাইলট ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম ছোট বিমান বা ড্রোন রয়েছে। তবে ডোনের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে।
এ ছাড়া পানিপথে চলাচল ও যুদ্ধের জন্য ৫০টি নানা আকৃতির জলযানও রয়েছে মার্কিন স্থলবাহিনীর (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। তবে অন্য কিছু উৎসে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে তথ্য পাওয়া যায়। গ্লোবাল ফায়ার এই তথ্যের বাইরে আরও তথ্য দিয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে। এই তথ্য মোতাবেক সামরিক শক্তিতে বলিয়ান শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো যথাক্রমে : আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত ও ফ্রান্স।
আকাশ ছোঁয়া সাফল্যে বিমান বাহিনী
মাটির নিচের বাংকার, কোনো দুর্ভেদ্য দুর্গ, সাগরের জাহাজ কিংবা আকাশে উড্ডীয়মান কোনো বিমান-শত্রুর অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, তা সমূলে ধ্বংস করার সক্ষমতা রয়েছে আমেরিকা বিমান বাহিনীর। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মোতাবেক বর্তমানে মার্কিন বিমান বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত জঙ্গি বিমানগুলোর মধ্যে ফাইটার বিমান ২,৩৬২টি, অ্যাটাক বিমান ২৮৩১টি, পরিবহন বিমান ১১৫৩টি, প্রশিক্ষণ বিমান ২৮৫৩টি। এ ছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই বিমানবাহিনী পরিচালনা করছে ৫৭৬০টি হেলিকপ্টার, যার মধ্যে ৯৭১টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার। বিমান বহরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় টি সিক্স-এ ট্যাক্সান টু এবং টি ৩৮৩ ট্যালন নামক প্রশিক্ষণ বিমান। আকাশে উড়ন্ত জঙ্গি বিমানে তেল সরবরাহের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় কেসি ১৩৫ স্ট্যাটোট্যাংকার বিমান রয়েছে ৩৪২টি।
পরিবহন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয় সি-১৭এ গ্লোব মাস্টার থ্রি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইটার এয়ারক্রাফট হিসেবে মার্কিন বিমান বাহিনীর আস্থা ধরে রেখেছে বহুল পরিচিত ও আলোচিত এফ-১৬ সি ফাইটিং ফ্যালকন। এমনি ধরনের বিভিন্ন কোম্পানি ৮৯ মডেলের বিমানে সুসজ্জিত মার্কিন বিমান বাহিনী। অন্যদিকে ৪১ ধরনের হেলিকপ্টার নিয়ে গড়ে উঠেছে মার্কিন বিমানবাহিনী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নানাবিধ কাজের উপযোগী বেল ২০৬ হেলিকপ্টার, এরপরই রয়েছে সিকরস্কা ইউএইচ ৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার। তল্লাশি ও তদন্ত কাজে পারদর্শী বেল ওএইচ-৫৮ কিওয়া এবং বেল এইচ-১৩ সিওয়াক্স হেলিকপ্টার। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণে পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম ভেরটল এইচ ২১ কার্গো হেলিকপ্টার।
অন্যদিকে সমুদ্রের পানির নিচে থাকা সাবমেরিনের অবস্থান বের করে তা ধ্বংস করতে পারে কামান এসএইচ-২ সিস প্রাইট হেলিকপ্টার। আমেরিকার বিখ্যাত বোয়িং কোম্পানির সিএইচ-৪৭ সিনুকে হেলিকপ্টারও রয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনীতে। ছয়টি ব্লেডের দুই সেট পাখাবিশিষ্ট এই হেলিকপ্টার ছোটখাটো বিমান, জাহাজ, ট্যাঙ্ক, কামান, গাড়ি এবং সরঞ্জামসহ ৮১ জন সৈন্য বহন বা দড়িতে দড়িতে ঝুলিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে সক্ষম। বর্তমানে মার্কিন বিমান বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছেন ফোর স্টার জেনারেল ডেভিড লি গোল্ড ফিয়েন। দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে অবস্থান করছে মার্কিন বিমান সেনারা।
না বলতে জানে না মার্কিন নৌ সেনা
বিভিন্ন দিক বিবেচনায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৌবাহিনী হিসেবে স্বীকৃত আমেরিকার নৌবাহিনী। সবচেয়ে বেশি বাজেট, শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ আর ব্যাপক জনবলের কারণে পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আমেরিকার নৌবাহিনী। শুধু আকার বা শক্তিমত্তাই নয়, গতিশীলতা এবং জল, স্থল এমনকি আকাশপথেও দ্রুত চলাচলের সামর্থ্য আমেরিকান নৌবাহিনীকে একটি আদর্শ ত্রিমাতৃক বাহিনীর মর্যাদা দিয়েছে। আমেরিকার নৌবাহিনীর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে হালনাগাদকৃত তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ৩,৩৪,০৬৯ জন নিয়মিত নৌ সেনা, লক্ষাধিক রিজার্ভ নৌ সেনা ২,৭৪,৮৫৪ জন বেসামরিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আমেরিকার নৌবাহিনী। এই বিশাল জনশক্তির অধীনে চলছে যুদ্ধে মোতায়েনের মতো ছোট বড় ২৯০টি নৌযান।
এর মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ে আছে ১১২টি সাবমেরিন, যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ৬৫টি যুদ্ধ জাহাজ আর নিজস্ব জলসীমা পাহারা দিচ্ছে ৪৭টি যুদ্ধ জাহাজ। বিভিন্ন মহাসাগরে ভাসানো হয়েছে ছয়টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যেখানে অনায়াসে ওঠানামা করতে পারে বিভিন্ন জঙ্গিবিমান। নৌবাহিনী বলতে সাধারণভাবে সমুদ্রে বা জলে বিচরণকারী জাহাজ ও নৌ যোদ্ধাদের চিহ্নিত করা হলেও আধুনিক নৌবাহিনী যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ত্রিমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। তাই আমেরিকার নৌবাহিনীর জাহাজ পানিতে ভাসে, নৌ বাহিনীরই নিজস্ব বিমান আকাশে ওড়ে এবং উভচর যান একই সঙ্গে জল ও স্থলে চলাচল করে শত্রুকে ঘায়েল করে। অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ছয় ধরনের যুদ্ধ জাহাজের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
যার প্রথমেই রয়েছে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং এম্ফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ, যা জল ও স্থলে চলতে পারে। এর পরই দেখানো হয়েছে ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ। যা একসঙ্গে একাধিক লক্ষবস্তুতে আঘাত করতে পারে। অন্য কোনো বন্ধুপ্রতিম বাহিনীকে সাহায্য করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে নির্দিষ্ট অভিযান চালাতে পারে। লিটোরাল কম্বেট শিপ রয়েছে পরের কাতারে। যা মূলত ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ মূলত উপকূলীয় এলাকায় যুদ্ধ করে, তবে প্রয়োজনে মাঝ সমুদ্রেও যেতে পারে। এই কম্বেট শিপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে ডেস্ট্রয়ার প্রকৃতির যুদ্ধজাহাজ। গতি ও ক্ষিপ্রতায় এ দুই ধরনের জাহাজ প্রায় এক রকম হলেও ডেস্ট্রয়ার নিজস্ব জলসীমা ও ভূখন্ডে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়। গভীর সমুদ্রে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন, যা যুদ্ধের সময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এসব সাবরেমিন, পারমাণবিক অস্ত্র বহন ও নিক্ষেপের কাজেও ব্যবহৃত হয়। ২০১৫ সালে শক্তিশালী আমেরিকান নৌবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন অ্যাডমিরাল জন রিচার্ডসন। নৌবাহিনীর মূল যুদ্ধজাহাজ হিসেবে আদিকাল থেকে ‘ফ্রিগেট’ ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকান নেভিতে বর্তমানে ২২টি ফ্রিগেট আছে। যার মূল কাজ শত্রুর হাত থেকে নিজ জলসীমার সব যুদ্ধযান, অন্যান্য রণতরী, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইত্যাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব ফ্রিগেটে বিমান হামলা বা সাবমেরিন হামলা প্রতিহত করার সক্ষমতা আছে।
আবার ফ্রিগেটের নিজস্ব কামান স্থলভাগের দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বা শত্রুর বিমান ধ্বংস করতে পারে। যে কোনো রণতরীকে চারপাশের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ২৭টি করভেটিস (ছোট রণতরী) রয়েছে আমেরিকার হাতে আরও রয়েছে দ্রুতগতির ক্রুজার। বিশ্বে নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ করে আমেরিকা। ২০২০ সালে আমেরিকা তার নৌবাহিনীর জন্য প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দ চেয়েছে। আমেরিকার নেভির সার্বিক শক্তিমত্তার একটি পরিচয় পাওয়া যায় উইকিপিডিয়ায় লিস্ট অব কান্ট্রিস বাই লেভেল অফ মিলিটারি ইকুইপমেন্ট বিভাগে।
মৃত্যুজয়ী এলিট ফোর্স মেরিন কোর
মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে এলিট ফোর্স হিসেবে স্বীকৃত মেরিন কোর, সংক্ষেপে ইউএস মেরিন। কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে গত মাসে (জুন ২০১৯) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন জেনারেল ডেভিড ইলবেরি বার্গারের হাতে। জল, স্থল ও আকাশপথে সমানতালে যুদ্ধ করার জন্য এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে সুদক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। স্বতন্ত্র অভিযান, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানে সমানভাবে পারদর্শী মেরিন সেনারা। যুদ্ধকৌশল হিসেবে যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ উদ্ধার অভিযানে নামানো হয় মেরিন সেনাদের। নিজ দেশে অবস্থান থেকে অনেক দূরে এমনকি শত্রু এলাকার অভ্যন্তরে কিংবা আরেকটি দেশে যুদ্ধ করতে কোনো দ্বিধা করে না মেরিন ফোর্স। আবার জল-স্থলে সমানভাবে যুদ্ধ করতে পারে বলে তারা উভচর বাহিনী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। উইকিপিডিয়ার হিসাবে ২০১৭ সালে মেরিন কোরে ১,৮২,০০০ নিয়মিত সৈন্য, ৩৮,৫০০ সংরক্ষিত সৈন্য এবং ১,৩০৪টি যুদ্ধবিমান ছিল। যে কোনো যুদ্ধে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরিন সৈন্যরা।
তারপর ক্রমান্বয়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে সার্বিক যুদ্ধে একটা সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা রয়েছে এই দলের। অস্ত্র হিসেবে প্রতিটি মেরিন সেনা কমপক্ষে একটি এম ১৬ রাইফেল অথবা এম ফোর কারবাইন অথবা কল্ট ৯ মি: মি: এসএমজি বহন করে। এ ছাড়াও ভারী মেশিনগান, গ্রেনেড নিক্ষেপের লাঞ্চার, কামান ও ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট এবং ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল চালনায় পারদর্শী মেরিন সৈনারা।
রণকৌশল হিসেবে মেরিন সেনারা সাধারণত নৌযানে করে উপকূলে পৌঁছে। ২০১৯ সালে মেরিন কোরের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ৪৩,১৫২ মিলিয়ন ডলার, যা পৃথিবীর বহু দেশের মোট বাজেটের চেয়েও বেশি। এই বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় জল, স্থল, ও আকাশপথে চলাচলের জন্য সাধারণ যানবাহন, জঙ্গিবিমান, যুদ্ধজাহাজ, মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট, ট্যাংক, কামান ও অন্যান্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
পরমাণুতে পরাক্রমশালী
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মূল দায়িত্ব পালন করছে জাতিসংঘ। অথচ জাতিসংঘের মোড়ল বলে স্বীকৃত ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং আমেরিকার হাতে রয়েছে চরম বিধ্বংসী মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা। এই পাঁচটি দেশই আবার আন্তঃমহাদেশীয় বেলাস্টিক মিসাইল ব্যবহার করে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে পারমাণবিক বোমা ফেলে দেশটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র গোপনে তৈরি করেছে অথবা তৈরির প্রক্রিয়ার আছে বলে মিডিয়ায় শিরোনাম হয় পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশ। তবে বিশ্বের বুকে সবার দুশ্চিন্তার কারণ আমেরিকা।
কারণ আমেরিকাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আমেরিকার একটি বোমারু বিমান জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ নামের ৪,৪০০ কেজি ওজনের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে ৬৬ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৬৯ হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয়, যাদের অধিকাংশ পরে মারা যায়। ঠিক তিন দিন পর ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট আমেরিকার আরেকটি যুদ্ধবিমান আবারও জাপানের নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাটম্যান’ নামের ৪,৬৭০ কেজি ওজনের আরেকটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এ ক্ষেত্রে ধ্বংস হয় নাগাসাকি শহর এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যু
র কোলে ঢোলে পড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। একই সংখ্যক মানুষ অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয়ে পরবর্তীতে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করে এবং ক্রমান্বয়ে মারা যায়। আমেরিকা এভাবে যুদ্ধে ব্যবহার ছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে ১০৫৪টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার হাতে সর্বোচ্চ ৩,১২,৫৫৫টি পারমাণবিক বোমা বা পারমাণবিক অস্ত্র ছিল।
পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্দোলন ও শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা কমতে থাকে। ১৯৯০ এর কাছাকাছি সময়ে সংখ্যা কমে প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছে। বর্তমানে ইউকিপিডিয়ার মতে, আমেরিকার হাতে প্রায় ৪,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র (বোমা) আছে, যার মধ্যে প্রায় ১,৮০০টি মোতায়েনকৃত এবং যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই ক্ষমতাবলেই আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ এবং মিলিটারি সুপার পাওয়ার বলে বিবেচিত।
ছোট-বড় বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের সক্ষমতা রয়েছে আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির নাম ডেভিক্রকেট, যা বাংলাদেশের একটি সাধারণ ঢেঁকির সমান।
আমেরিকা নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার এবং ক্রুজারজাতীয় যুদ্ধজাহাজ এবং তিন ধরনের সাবমেরিন ব্যবহার করে সমুদ্র থেকে জল-স্থল বা আকাশে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। আমেরিকার গোলন্দাজ বাহিনীও বিশেষ কামানের মাধ্যমে পরমাণু বোমা সংযুক্ত শেল নিক্ষেপ করতে পারে।
আর বিমান বাহিনী এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা প্রমাণ করেছে নানা প্রকার সামরিক মহড়া ও পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের সময়। আমেরিকার যে কোনো বড় আকারের পারমাণবিক বিস্ফোরণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রেসিডেন্টের যিনি সার্বিকভাবে সেনা, নৌ, বিমান ও মেরিন বাহিনীরও সর্বময় প্রধান বা কমান্ডার ইন চিফ। এই আদেশটি একটি বিশেষ কোড আকারে দিয়ে থাকেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতার ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এক নজরে ২০১৭ সালের মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনী
👉 নিয়মিত সৈন্য (স্থলবাহিনী) ৪,৭২,০৪৭ জন
👉 আর্মি ন্যাশনাল গার্ড ৩,৪৫,১৫৩ জন
👉 নিয়মিত নৌ সেনা ৩,১৯,৪৯২ জন
👉 নিয়মিত বিমান সেনা ৩,১৮,৫৮০ জন
👉 আর্মি রিজার্ভ (সংরক্ষিত সেনা) ২,১৯,০৫৪ জন
👉 নিয়মিত মেরিন সৈন্য ১,৮৪,৪০১
👉 এয়ার ন্যাশনাল গার্ড ১,০৫,৬৭০ জন
👉 মেরিন কোর রিজার্ভ (সংরক্ষিত মেরিন সেনা) ১,০৪,৪১৯ জন
👉 সংরক্ষিত নৌ সেনা ১,০৩,৬৬০ জন
👉 সংরক্ষিত বিমান সেনা ৯৯,২৬৯ জন
👉 নিয়মিত কোস্টগার্ড সৈন্য ৪০,৬০০ জন
👉 সংরক্ষিত কোস্টগার্ড সৈন্য ৭,৮৫৭ জন
সূত্র : মার্কেট পোর্টাল স্টেটিসটিকা.কম
Post A Comment: