কিউবার মিসাইল ক্রাইসিসঃ পৃথিবী যখন পৌঁছেছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ১৯১৪-১৮ এবং ১৯৩৯-৪৫ সালের এ দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। ধ্বংস হয়েছে নগর-শহর-গ্রাম, বিশ্ববাসী দেখেছে নৃশংসতা ও নির্মমতার চরমতম বহিঃপ্রকাশ, ডুকরে কেঁদেছে মানবতা। আমাদের সৌভাগ্য, সেরকম ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ আমাদের আর দেখতে হয়নি। তবে একাধিকবার এমন ঘটনাও ঘটেছে, যখন পৃথিবী আরো একটা বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। যদিও সংশ্লিষ্টদের বিচক্ষণতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তেমনই একটি ছিল ১৯৬২ সালের কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস।
জুলাই ১৯৬২, চিরশত্রু দুই দেশ পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ তখন চরমে। আগের বছরই কিউবায় সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে পিগ উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তবুও কিউবা তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। যেকোনো সময় বৈরী প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্র আবার আক্রমণ করতে পারে। তাই কিউবার সরকার নিরাপত্তার জন্য তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য চায়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশচেভ সাড়া দেন। কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোকে জানান, তাঁরা কিউবার নিরাপত্তার জন্য সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করে দেবেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে আক্রমণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেও একটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছায় এ বিবেচনায় যে, তাদের এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে হামলা করার সক্ষমতা ছিল না। কারণ তাদের তখন প্রচুর শর্ট ও ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল থাকলেও লংরেঞ্জ মিসাইল প্রযুক্তিতে তারা তখনো যথেষ্ট উন্নতি করতে পারেনি। কাজেই কিউবায় মিসাইল স্থাপন করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে আওতার মধ্যে আনার সুযোগ তারা পেয়ে যায়।
কিছুদিনের মধ্যেই কিউবায় শুরু হয়ে যায় সোভিয়েত মিসাইল স্থাপনের কাজ। সমুদ্রপথে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পারমাণবিক মিসাইল এসে পৌঁছায় কিউবায়। তাক করে রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে কিছু বুঝতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে তারা প্রথম এ সম্পর্কে কিছু ধারণা পায়। তবে নিশ্চিত হয় ১৪ অক্টোবর যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর U-2 গোয়েন্দা বিমান কিউবায় স্থাপিত সোভিয়েত মিসাইলের স্পষ্ট ছবি তুলে আনে। নড়েচড়ে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। এ তো তাঁদের জন্য বিরাট হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলের মাত্র ৮০ মাইলের মধ্যে শত্রুদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক মিসাইল!
হোয়াইট হাউজে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বসেন কেনেডি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বোমা হামলা করে কিউবায় স্থাপিত সোভিয়েত মিসাইল সিস্টেমগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হবে, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী উভচর অপারেশন চালিয়ে কিউবা দখল করে নেবে। যদিও এ সিদ্ধান্ত ছিল আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ শুরুরই নামান্তর। কারণ কিউবা তখন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য, অস্ত্র, জাহাজ ও বিমানে ভর্তি হয়ে আছে। তাই কেউ কেউ কেনেডিকে আরেকবার ভেবে দেখতে পরামর্শ দেন।
শেষ পর্যন্ত কেনেডি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। বোমা ও স্থল হামলার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তিনি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার চারদিকে নৌ-অবরোধ বসান। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় কিউবার ওপর মার্কিন নৌবাহিনীর “নেভাল কোয়ারেন্টিন”। কিউবার চারদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো অবস্থান নেয়। বহির্বিশ্ব থেকে কিউবা তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এবং সব সরবরাহ বন্ধ। এরই মধ্যে একদিন কিউবার দিকে আসতে থাকা সোভিয়েত নৌবাহিনীর কয়েকটা যুদ্ধজাহাজ মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর মুখোমুখি হয় (যদিও অফেনসিভ কিছু ঘটেনি)। কিউবা তখন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। সোভিয়েত মিসাইলগুলো তখনো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাক করা যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে যাবে, অবস্থা তখন সে রকম পর্যায়ে।
একইদিন কেনেডি টিভি ভাষণে সর্বপ্রথম দেশবাসীকে জানান যে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল তাঁদের দিকে তাক করা আছে। দেশবাসী একইসাথে স্তম্ভিত ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্যগুলোতে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। ঘরে ঘরে বাংকার তৈরি হয়, যাতে যুদ্ধের সময় আশ্রয় নেওয়া যায়। পারমাণবিক আক্রমণ হলে কী করণীয় তা নিয়ে জনগণকে সচেতন করা শুরু হয়।
বিশ্ববাসী আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর চোখ তখন কিউবায় নিবদ্ধ। ২৪ অক্টোবর ক্রুশচেভ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, মার্কিন নৌ-অবরোধকে তাঁরা আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাই কিউবার নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা মিসাইলগুলো সরাবেন না। ফলে ২৬ অক্টোবর কেনেডি কিউবায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। বিশ্ববাসীর নিশ্বাস যেন আটকে থাকলো।
কিন্তু সেদিনই একটা ঘটনা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট চিঠিতে জানান, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিশ্চয়তা দেয় যে তারা কিউবায় কখনো সামরিক অভিযান চালাবে না, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করে নেবে। কেনেডি তা মেনে নেন এবং পৃথিবী কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
কিন্তু পরদিনই আবার উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জানান, তাঁদের সীমান্তের কাছে তুরষ্কে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। তবেই তাঁরা কিউবা থেকে সরে আসবেন। কিন্তু কেনেডি তা মেনে নেননি। তিনি আবারও কিউবায় সামরিক অভিযানের পক্ষে মত দেন। তাতে যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ লাগে লাগুক। একইদিন কিউবার ওপর নজরদারি চালানোর সময় একটি মার্কিন U-2 গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত হয় সোভিয়েত মিসাইলে। উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। এবার বুঝি আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর কোন উপায় নেই!
তবে কেনেডি ছিলেন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতা। এতকিছুর পরও তিনি কূটনৈতিক সমাধানের সব পথ বন্ধ করে দেননি। তিনি আরো কিছু সময় নেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানান, ধীরে ধীরে তুরষ্ক থেকে তাঁরা মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করবেন, কিন্তু এখনই নয়। তবে তিনি কথা দেন যে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণ করবে না, যদি অতিশীঘ্রই কিউবা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
পরদিন ২৮ অক্টোবর যেন বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ক্রুশচেভ যুক্তরাষ্ট্রের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে কিউবা থেকে সব পারমাণবিক মিসাইল সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। অবসান হয় ১৫ দিনব্যাপী রুদ্ধশ্বাস অবস্থার। যুক্তরাষ্ট্রও ধীরে ধীরে ২০ নভেম্বরের মধ্যে কিউবার ওপর থেকে নৌ-অবরোধ সরিয়ে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে মিসাইলগুলোও প্রত্যাহার করে নেয়।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন এটাই ছিল দুই পরাশক্তির সবচেয়ে বড় বিরোধ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল তখনই। যদিও দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বিচক্ষণতার কারণে বিশ্ব আরো একটি ভয়াবহ সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এ ঘটনার পর কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের মাত্রা কিছুমাত্র কমেনি বরং এরকম আরো অনেক ঘটনায় দু’পক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। সে গল্প শুনতে চাইলে কমেন্ট করে আমাদেরকে জানান। ধন্যবাদ।
জুলাই ১৯৬২, চিরশত্রু দুই দেশ পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ তখন চরমে। আগের বছরই কিউবায় সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে পিগ উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তবুও কিউবা তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। যেকোনো সময় বৈরী প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্র আবার আক্রমণ করতে পারে। তাই কিউবার সরকার নিরাপত্তার জন্য তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য চায়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশচেভ সাড়া দেন। কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোকে জানান, তাঁরা কিউবার নিরাপত্তার জন্য সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করে দেবেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে আক্রমণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেও একটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছায় এ বিবেচনায় যে, তাদের এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে হামলা করার সক্ষমতা ছিল না। কারণ তাদের তখন প্রচুর শর্ট ও ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল থাকলেও লংরেঞ্জ মিসাইল প্রযুক্তিতে তারা তখনো যথেষ্ট উন্নতি করতে পারেনি। কাজেই কিউবায় মিসাইল স্থাপন করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে আওতার মধ্যে আনার সুযোগ তারা পেয়ে যায়।
![]() |
Missile Base Captured By U2 Spy Plane |
কিছুদিনের মধ্যেই কিউবায় শুরু হয়ে যায় সোভিয়েত মিসাইল স্থাপনের কাজ। সমুদ্রপথে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পারমাণবিক মিসাইল এসে পৌঁছায় কিউবায়। তাক করে রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে কিছু বুঝতে পারেনি। সেপ্টেম্বরে তারা প্রথম এ সম্পর্কে কিছু ধারণা পায়। তবে নিশ্চিত হয় ১৪ অক্টোবর যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর U-2 গোয়েন্দা বিমান কিউবায় স্থাপিত সোভিয়েত মিসাইলের স্পষ্ট ছবি তুলে আনে। নড়েচড়ে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। এ তো তাঁদের জন্য বিরাট হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলের মাত্র ৮০ মাইলের মধ্যে শত্রুদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক মিসাইল!
![]() |
National Security Council Meet at The White House |
হোয়াইট হাউজে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বসেন কেনেডি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বোমা হামলা করে কিউবায় স্থাপিত সোভিয়েত মিসাইল সিস্টেমগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হবে, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী উভচর অপারেশন চালিয়ে কিউবা দখল করে নেবে। যদিও এ সিদ্ধান্ত ছিল আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ শুরুরই নামান্তর। কারণ কিউবা তখন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য, অস্ত্র, জাহাজ ও বিমানে ভর্তি হয়ে আছে। তাই কেউ কেউ কেনেডিকে আরেকবার ভেবে দেখতে পরামর্শ দেন।
শেষ পর্যন্ত কেনেডি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। বোমা ও স্থল হামলার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তিনি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার চারদিকে নৌ-অবরোধ বসান। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় কিউবার ওপর মার্কিন নৌবাহিনীর “নেভাল কোয়ারেন্টিন”। কিউবার চারদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো অবস্থান নেয়। বহির্বিশ্ব থেকে কিউবা তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এবং সব সরবরাহ বন্ধ। এরই মধ্যে একদিন কিউবার দিকে আসতে থাকা সোভিয়েত নৌবাহিনীর কয়েকটা যুদ্ধজাহাজ মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর মুখোমুখি হয় (যদিও অফেনসিভ কিছু ঘটেনি)। কিউবা তখন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। সোভিয়েত মিসাইলগুলো তখনো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাক করা যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে যাবে, অবস্থা তখন সে রকম পর্যায়ে।
![]() |
Television Broadcasting |
একইদিন কেনেডি টিভি ভাষণে সর্বপ্রথম দেশবাসীকে জানান যে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল তাঁদের দিকে তাক করা আছে। দেশবাসী একইসাথে স্তম্ভিত ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্যগুলোতে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধের প্রস্তুতি। ঘরে ঘরে বাংকার তৈরি হয়, যাতে যুদ্ধের সময় আশ্রয় নেওয়া যায়। পারমাণবিক আক্রমণ হলে কী করণীয় তা নিয়ে জনগণকে সচেতন করা শুরু হয়।
বিশ্ববাসী আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর চোখ তখন কিউবায় নিবদ্ধ। ২৪ অক্টোবর ক্রুশচেভ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, মার্কিন নৌ-অবরোধকে তাঁরা আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাই কিউবার নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা মিসাইলগুলো সরাবেন না। ফলে ২৬ অক্টোবর কেনেডি কিউবায় সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। বিশ্ববাসীর নিশ্বাস যেন আটকে থাকলো।
কিন্তু সেদিনই একটা ঘটনা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট চিঠিতে জানান, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিশ্চয়তা দেয় যে তারা কিউবায় কখনো সামরিক অভিযান চালাবে না, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করে নেবে। কেনেডি তা মেনে নেন এবং পৃথিবী কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
কিন্তু পরদিনই আবার উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জানান, তাঁদের সীমান্তের কাছে তুরষ্কে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। তবেই তাঁরা কিউবা থেকে সরে আসবেন। কিন্তু কেনেডি তা মেনে নেননি। তিনি আবারও কিউবায় সামরিক অভিযানের পক্ষে মত দেন। তাতে যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ লাগে লাগুক। একইদিন কিউবার ওপর নজরদারি চালানোর সময় একটি মার্কিন U-2 গোয়েন্দা বিমান ভূপাতিত হয় সোভিয়েত মিসাইলে। উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। এবার বুঝি আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর কোন উপায় নেই!
![]() |
President John F Kennedy |
তবে কেনেডি ছিলেন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতা। এতকিছুর পরও তিনি কূটনৈতিক সমাধানের সব পথ বন্ধ করে দেননি। তিনি আরো কিছু সময় নেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানান, ধীরে ধীরে তুরষ্ক থেকে তাঁরা মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করবেন, কিন্তু এখনই নয়। তবে তিনি কথা দেন যে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় আক্রমণ করবে না, যদি অতিশীঘ্রই কিউবা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইলগুলো প্রত্যাহার করে নেয়।
পরদিন ২৮ অক্টোবর যেন বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ক্রুশচেভ যুক্তরাষ্ট্রের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে কিউবা থেকে সব পারমাণবিক মিসাইল সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। অবসান হয় ১৫ দিনব্যাপী রুদ্ধশ্বাস অবস্থার। যুক্তরাষ্ট্রও ধীরে ধীরে ২০ নভেম্বরের মধ্যে কিউবার ওপর থেকে নৌ-অবরোধ সরিয়ে নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে মিসাইলগুলোও প্রত্যাহার করে নেয়।
![]() |
Lockheed U2 Spy Plane |
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন এটাই ছিল দুই পরাশক্তির সবচেয়ে বড় বিরোধ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল তখনই। যদিও দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বিচক্ষণতার কারণে বিশ্ব আরো একটি ভয়াবহ সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এ ঘটনার পর কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের মাত্রা কিছুমাত্র কমেনি বরং এরকম আরো অনেক ঘটনায় দু’পক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। সে গল্প শুনতে চাইলে কমেন্ট করে আমাদেরকে জানান। ধন্যবাদ।
Post A Comment: